মলদ্বারের যেকোন সমস্যাকেই সাধারণ মানুষ পাইলস্ বলে অভিহিত করে থাকে। পাইলস্ মুলত মলদ্বারের রক্তনালীর সমস্যা। মলদ্বারের রক্তনালী যখন ফুলে আকাবাঁকা হয়ে যায় এবং রক্তনালী ও মলদ্বারের দেয়ালের মধ্যবর্তী বন্ধন দুর্বল হয়ে রক্তনালীগুলো নীচের দিকে ঝুলে পড়ে তখনই মলদ্বারে পাইলস্ দেখা দেয়। সাধরন মানুষ যে বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত বিচলিত সেটি হল-তারা মনেকরে পাইল্স থেকে মলদ্বারে ক্যান্সার হতে পারে কিন্তু ধারনাটি সঠিক নয়। সাধারনত পাইল্স থেকে মলদ্বারে কখনও ক্যান্সার হয়না।
পাইল্স কেন হয়?
১। মলত্যাগ সংক্রান্ত কারন
– দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য
– মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত কোৎ দেয়া
– প্রতিদিন মলত্যাগ না করা
২। খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত কারন
– কম আাঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ
৩। রোগ সংক্রান্ত কারন
– দীর্ঘস্থায়ী কাশি
– প্রস্রাবে বাঁধা
– লিভার সিরোসিস
৪। মলাশয়রে ক্যান্সার
৫। গর্ভাবস্থা
পাইল্স উৎপত্তির প্রক্রিয়াঃ
দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য পুনঃপুনঃ শক্ত মলত্যাগের ফলে মলদ্বারের রক্তনালীগুলো যে পেশীর সাহায্যে মলদ্বারের দেয়ালের সাথে আটকানো থাকে সেই পেশীগুলো ছিড়ে যায় অথবা দুর্বল হয়ে যায় এর ফলে মলদ্বারের রক্তনালীগুলো নীচের দিকে ঝুলে
পাইলস এর কুন্ডলী – Piles Symptom
চিত্রঃ পাইল্স পূণ্ডলী।
পড়ে । মলত্যাগের সময় যখন কোৎ দেয়া হয় তখন মলদ্বারের রক্তনালীর মধ্যে রক্ত জমা হয়ে ঝুলেপড়া রক্তনালীরগুলো ফুলেউঠে এবং আরোবেশী ঝুলেপড়ে। এছাড়া ম্যাট্রিক্স মেটালোপ্রটিনেজ নামক একপ্রকার এনজাইম-এর উপস্থিতি মলদ্বারের রক্তনালী ও মলদ্বারের দেয়ালের মধ্যবর্তী বন্ধন ধ্বংস করে রক্তনালীকে নীচের দিকে ঝুলে পড়ে পাইল্স উৎপত্তিতে ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ঝুলেপড়া রক্তনালীগুলো মলত্যাখের সময় পুন্ডলী আকারে বাইরে বের হয়ে আসে যা মলত্যাগ শেষে পূণরায় ভিতরে ঢুকে যায় কিন্তু পরবর্তী
পর্যায়ে বাইরে বেরহয়ে আসা এই রক্তনালীর পুন্ডলীগুলো হাতের সাহায্য ব্যতীত পূণরায় ভিতর প্রবেশ করেনা।
পাইল্স এর পর্যায় সমূহ
১ম পর্যায় : মলদ্বার দিয়ে ফোটায় ফোটায় রক্ত পড়ে। মলত্যাগরে সময় কোনপ্রকার মাংশপণ্ডি বাইরে বরে হয়না।
২য় পর্যায় : মলত্যাগের সময় মলদ্বার দিয়ে মাংশ পিন্ড বের হয়ে আসে যা মলত্যাগের শেষে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায়।
৩য় পর্যায় : মলত্যাগের সময় যে মাংশ পিন্ড বাইরে বের হয়ে আসে তা মলত্যাগের শেষে নিজে ভেতরে ঢুকবে না বরং হাত দিয়ে ভেতরে ঢুকাতে হয়।
৪র্থ পর্যায় : মাংশ পিন্ড টি সব সময় বাইরেই থাকে কখনও ভিতরে ঢুকবে না।
পাইল্স নির্নয়ঃ
সাধারণত প্রক্টোসকপির সাহায্যে মলদ্বার পর্যবেক্ষণ করে পাইলস্ এর অবস্থা, অবস্থান এবং পর্যায় নির্ণয় করা যায়। পাইলস্ ব্যতীত অন্য কোন রোগ সন্দেহ হলে কলোনোস্কপির সাহায্যে রোগ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
পাইল্স প্রতিরোধ
১। উচ্চ আঁশযুক্ত খাবার গ্রহন ও পরমিতি পানপিান করতে হব।ে
২। কোষ্ঠকাঠিন্য পরহিার করা।
৩। নিয়মিত মলত্যাগ করা।
৪। মলত্যাগের সময় অতরিক্তি কোৎ না দেওয়া।
৫। নিয়মিত শরীর চর্চা।
৬। দীর্ঘ সময় বসে কাজ না করা।
পাইল্স–এর চিকিৎসাঃ
পাইল্স-এর বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। পাইল্স-এর পর্যায়ের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়।
(ক) জীবনধারা ও খাদ্যাভাসের পরিবর্তন।
(খ) উষধের সাহায্যে চিকিৎসাঃ
মলদ্বারের পাইলস্ যদি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে তাহলে নিয়মিত ঔষুধ সেবনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন জটিলতামুক্ত থাকা যায়। এজন্য মলদ্বারের পাইলস্- এর কোন লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই পাইলস্ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
(গ) ইনজেকশনের মাধ্যমে (স্ক্লেরো থেরাপী)
প্রাথমিক পর্যায়ের পাইল্স-এর জন্য এই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এটি একটি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি।
(ঘ) রাবার ব্যান্ড লাইগেশন।
২য় পর্যায়ের পাইল্স-এর জন্য এই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিতে পাইল্স পূন্ডলীর গোড়ায় বিশেষ ধরনের মেশিনের সাহায্যে একটি রাবার ব্যান্ড পরিয়ে দেয়া হয়। এক সপ্তাহ পর পাইল্স পূন্ডলীটি খসে পড়ে যায়। এটি একটি ব্যথাহীন কার্যকর পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসার জন্য রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়না।
(ঙ) অপারেশনের মাথ্যমে চিকিৎসাঃ
সাধারনত ৩য় ও ৪র্থ পর্যায়ের পাইল্স এবং যেসমস্ত ২য় পর্যায়ের পাইল্স অপারেশন ব্যতীত অনান্য চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নিরাময় হয়না সেক্ষেত্রে অপারেশনের মাধ্যমে পাইল্স এর চিকিৎসা করা হয়।
১। হাতে কেটে অপারেশনঃ
পাইল্স পূন্ডলীটি কেটেফেলা হয় ফলে মলদ্বারে ক্ষত সৃষ্টি হয় যা সম্পূর্ণ শুকাতে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ সময় লাগে। এই পুরোসময়ে হিপবাথ (কুসুম গরম পানিতে উষধ মিশিয়ে পানিতে বসা) নেবার প্রয়োজন হয় এবং মলদ্বারে অনেক ব্যথা অনুভূত হয়।
২। মেশিনের মাধ্যমে অপারেশন (লজ্ঞো অপারেশন) ।
বর্তমানে এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে PPH নামক মেশিনের (একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়) সাহায্যে পাইল্স কুন্ডলীটি কেটে স্বয়ংক্রিয় ভাবে সেলাই হয়ে যায় ফলে মলদ্বারে কোনপ্রকার ক্ষতসৃষ্টি হয়না এবং অপারেশন পরবর্তী সময়ে হিপবাথ (কুসুম গরম পানিতে উষধ মিশিয়ে পানিতে বসা) নেবার প্রয়োজন হয়না। এই পদ্ধতিতে অপারেশন পরবর্তী সময়ে কেটে করা অপারেশনের চেয়ে অনেক কম ব্যথা অনুভূত হয় ফলে রোগী অতি অল্পসময়ের মধ্যে স্বাভাবীক কাজে ফিরতে পারে।
চিত্রঃ PPH ষ্ট্যাপলার(লঙ্গো মেশিন)।
(চ) পাইল্স–এর অনান্য চিকিৎসা পদ্ধতিঃ
১। ইনফ্রারেড ফটোকোয়াগুলেশনঃ
এই পদ্ধতিতে বিশেষ ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে তাপ প্রয়োগ করে পাইল্স কুন্ডলীতে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালীটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এটি একটি ব্যথাবিহীন চিকিৎসা পদ্ধতিটি কিন্তু বহুল ব্যবহ্নত নয়।
২। ট্রান্সএনাল হেমোরয়ডাল ডিআর্টারিয়ালাইজেশনঃ
এটি পাইল্স-এর নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ডপলার নামক যন্ত্রের সাহায্যে পাইল্স পূন্ডলীতে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালী সনাক্ত করে সুতা দিয়ে বেধে দেয়া হয়। এটিও বহুল ব্যবহৃত বা প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা পদ্ধতি নয়।
সাধারনত আমাদের দেশে এই সকল চিকিৎসা পদ্ধতি(ইনফ্রারেড ফটোকোয়াগুলেশন, ট্রান্সএনাল হেমোরয়ডাল ডিআর্টারিয়ালাইজেশন) ব্যবহার করে পাইল্স-এর চিকিৎসা করা হয়না।
পাইল্স এর জটিলতাসমূহ
যথাযথ চিকিৎসা না করালে পাইলস্গুলো বড় হতে থাকে এবং নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি করতে থাকে। যেমন :
১। রক্তপাতের ফলে শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
২। পুন্ডলী মলদ্বারের বাইরে এসে অবস্থান করতে থাকার ফলে পুন্ডলীতে ঘা হয়ে মলদ্বারে প্রচন্ড ব্যথা, মলদ্বার থেকে আঠালো রস নিঃসরন হতে থাকে এবং মলদ্বার চুলকায়।
৩। পুন্ডলীতে রক্ত জমাটবেঁধে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হতে পারে এবং রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পূণ্ডলীটি পচে যেতে পারে